ভূমিকা
: পীরগাছা নামকরেণের ইতিহাস-
অতীতকে
জানার আগ্রহ মানুষের সহজাত । মানুষ তার অতীতকে জেনে এগুতে চায়। অতীত ঐতিহ্য
মানুষের গর্বের বিষয়। যুগে যুগে মানুষ অতীতের সভ্যতা ও কৃষ্টি জানার আগ্রহ
দেখিয়েছে । ইতিহাস যত ক্ষুদ্র হোকনা কেন সে ইতিহাস মানুষের গর্বের । এ ক্ষেতে
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার নামকরনের সঠিক কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও জনশ্রুতিতে আছে,
অতীতে এখানে ইসলাম প্রচারে পীরদের আগমন ঘটেছিল । ইসলাম প্রচারে আসা পীর, ওলি, গাউস
যাঁদের স্মৃতি নামকরনের মধ্যে লুকিয়ে আছে । জনশ্রুতি কিংবা কিংবদন্তি ইতিহাসের
উপকরণ নয়, তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই কোন না কোন স্থানের নাম বা তার উৎস খোঁজার জন্য
কোন না কোন ভাবে জনশ্রুতির উপর নির্ভর করতে হয়। পীর, ওলি, গাউসরা এখানে দীর্ঘদিন
আস্তানা গড়ে ধর্ম প্রচার করেছিলেন। এদের ব্যবহারের জন্য ছিল একটি কুপি বা প্রদীপ
রাখার বিশাল গছা (বাঁশ জাতিয়) । সে বাতির আলো দুর থেকে দেখা যেত । অবশেষে পীররা
চলে যাওয়ার সময় বাঁশের গছাটি পরিত্যক্ত রেখে যান । জনশ্রুতিতে আছে তখন থেকেই ভক্ত
মুরিদরা ওই গছা টিকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে আসত । এ কারণে পীর ও তার গছা থেকে
বিবর্তনের ধারায় পীরগাছা নামের উৎপত্তি হয়েছে।
বিগত
২৬ জানুয়ারি ১৯৮৩ বাংলাদেশ গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবক
১৯৮২ সালের ১৫ ডিসেম্বর হতে পীরগাছাকে মান উন্নীত থানা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৪
সাল হতে মান উন্নীত থানাসমূহ উপজেলা প্রশাসন চালু করা হয়। বর্তমানে পীরগাছা উপজেলা
হিসেবে কার্যক্রম চলছে। ৯টি ইউনিয়ন
১৭০টি মৌজা, ১৮৯টি গ্রাম । মোট জন সংখ্যা ৩,২৯,৬৪৪ জন (ডিসেম্বর/০৭ পরিসংখ্যান
তথ্য সুত্রে) । উপজেলায় ভূ-প্রকৃতি সমতল । মানাস, আলাইকুড়ি, ঘাঘট, তিস্তা পলল
ভূমির অন্তর্গত। মোট জমির পরিমাণ ৪৯ হাজার ৫৩ হেক্টর । আবাদী জমি ২০ হাজার ৬ শত ৩
হেক্টর । প্রধান ফসল ধান, আলূ, ভুট্টা, পাট ও আখ। যোগাযোগের ক্ষেত্রে রয়েছে রেল ও
সড়ক পথ । ২১ কিঃ মিঃ রেল পথে ৩টি স্টেশন, অন্নদানগর, পীরগাছা ও চৌধুরানী । পাকা
সড়ক ৮০.৪৮ কিঃ মিঃ। কাঁচা সড়ক ৪৪৯.৮৬ কিঃমিঃ । যোগাযোগের মাধ্যম ট্রেন, বাস,
ট্রাক, রিক্সা-ভ্যান ও গরুর গাড়ি। এ উপজেলায় শিক্ষার হার ৪১.২১ % । শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান ডিগ্রী মহাবিদ্যালয় ৩টি, মহাবিদ্যালয় ৬টি ও স্কুল এন্ড কলেজ ১টি,
মাদরাসা ৩৮টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৪২টি, নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় ৯টি, সরকারি
প্রাথমিক বিদ্যালয় ৭২টি, বেসরকারি রেজিষ্টার্ড ৭৭টি, সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা ৫টি,
আলিম ২টি, দাখিল ৩৪টি, স্বতন্ত্রএবতেদায়ী ৫৬টি রয়েছে। ঐতিহাসিক স্থান সমূহের মধ্যে
মন্থনা জমিদার বাড়ি, ইটাকুমারী জমিদার বাড়ি চন্ডিপুরে মোঘল আমলের মসজিদ, চৌধুরানী
বাজারে দেবী চৌধুরানী কর্তৃক খননকৃত দীঘি । রয়েছে শৈল্পনন্দিক শহীদ মিনার, শাপলা
চত্বর, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরনে স্বাধীনতা চত্বর । মহান
স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সন্মুখ যুদ্ধে এ উপজেলার ৫ জন
মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে । এ ছাড়াও এ উপজেলায় রয়েছে নব্দীগজ্ঞ বধ্যভূমি । রয়েছেন
বেশ ক’জন কৃর্তিমান ব্যক্তি । যারা রাজনীতি, সাহিত্য ও সাংবাদিকতা পেশায় অমর হয়ে
রয়েছেন । পীরগাছার ঐতিহাসি স্থান সমুহের
মধ্যে ইটাকুমারী রাজবাড়ী অন্যতম।
রাজবাড়ীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ফতেহপুর চাকলা সরকার
কোচবিহারের এক বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল। মোগল অভিযানের প্রাক্কালে এ চাকলায় ছয়
আনা অংশের অধিকারী নরোত্তম নামক বৈদ্যবংশীয় ব্যক্তি। কোচবিহার মহারাজা দফতরে একজন
কানুনগো ছিলেন। তার পুত্র রঘুনাথ, রঘুনাথের পুত্র সুকদেব
নন্দী এবং সুকদেব নন্দীর পুত্র রাজা রায় উক্ত পরগনার জমিদার হন। রাজা রায়ের ৭
সন্তানের মধ্যে ২ জন ছাড়া কারো কোন পুত্র সন্তান না
থাকায় ছয় আনা অংশের চাকলা ফতেহপুর উক্ত দুই পুত্রের মধ্যে বিভাজন করে দেয়া হয়।
প্রথম ভাগ তিন আনা ফতেহপুর (যা ইটাকুমারী নামে খ্যাত) লাভ করেন রাজা রায়ের জ্যৈষ্ঠ
পুত্র শিবচন্দ্র। অপর অংশ পরগনা যা উদাসী নামে খ্যাত যা রাজারায়ের অপর পুত্রের মাধ্যমে
জনৈক বারেন্দ্রীয় ব্রাহ্মণের কাছে হস্তান্তরিত হয়। তিন আনা ফতেহপুরের অধিকারী
শিবচন্দ্র ইটাকুমারীতে তার রাজবাড়ী নির্মাণ করেন। ইটাকুমারী ফতেপুর পরগনার ৪১৩.৮৮
একর বিশিষ্ট একটি গ্রাম যা পীরগাছা হেডকোয়ার্টার থেকে ৮
কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
বুকাননের বিবরণ ছাড়া এই জমিদার বংশ
সম্পর্কে বিশেষ কোন ইতিহাস আজও্ত লিপিবদ্ধ হয়েছে বলে জানা যায় না। ইটাকুমারীর
ঊনবিংশ শতাব্দীর কবি রথিরাম দাসের জাগের গান কবিতায় জানা যায় যে, শিবচন্দ্র যখন ইটাকুমারীর জমিদার তখন রংপুর-দিনাজপুরসহ সমগ্র উত্তরবঙ্গে
প্রজা বিদ্রোহের সময়কাল। রাজস্ব সময়মত পরিশোধ না করার কারণে ইজারাদার দেবী সিংহের
দ্বারা রংপুরের যে সমস্ত জমিদার নিগৃহীত ও অত্যাচারিত হয়েছিলেন তার মধ্যে রাজা
শিবচন্দ্র অন্যতম। দেবী সিংহ ও তার সহকারী হররাম সেনের লাঠিয়াল বাহিনী শিবচন্দ্রকে
গ্রেফতার করে রংপুর মীরগঞ্জে দেবী সিংহের কুটিবাড়ীতে অন্ধকার ঘরে আবদ্ধ করে রাখে।
তার স্ত্রী অন্যান্য বন্দী জমিদারের স্ত্রীদের নিয়ে নিজ নিজ স্বামীর মুক্তির জন্য
সাবিত্রীব্রত পালন করেন। বহু টাকার বিনিময়ে রাজা শিবচন্দ্র মুক্তি পেলে
ইটাকুমারীতে সমগ্র রংপুর অঞ্চলের জমিদারের এক সম্মেলন আহবান করেন। যেখানে মন্থনার
বিদ্রোহী জমিদারনী জয়দুর্গা দেবী চৌধুরাণীও যোগ দেন। অতঃপর সেখান থেকে শিবচন্দ্র
ও দেবী চৌধুরাণী প্রজা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়ে দেবী সিংহের অত্যাচার থেকে রংপুরের
কৃষক প্রজাদের রক্ষা করেন। রাজা শিবচন্দ্র কতদিন বেঁচে ছিলেন তা জানা যায় না,
তবে তিনি ফতেহপুর চাকলার তিন আনার অর্ধেকাংশের মালিক হিসাবে তদীয়
একমাত্র পুত্র নবকুমারকে তার উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেন। নবকুমার পুত্রহীন অবস্থায়
মারা গেলে তদীয় বিধবা স্ত্রী কালিশ্বরীর দত্তকপুত্র উক্ত তিন আনা ফতেহপুরের মালিক
হন। শিবচন্দ্রের অপর ভ্রাতা সূর্যচন্দ্র যিনি কৃষ্ণ নামেও পরিচিত ছিলেন তার ৩
সন্তান ছিল। একজন অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে তার দু'পুত্র
নরেন্দ্র ও বিষ্ণু নারায়ণের মধ্যে জমিদারী বিভাজন হন। বুকাননের রংপুর ভ্রমণের সময়
নরেন্দ্রের রাণী অন্নপূর্ণা তার নাবালক দু'পুত্র
রাজচন্দ্র ও কাশীচন্দ্রের পক্ষে জমিদারি পরিচালনা করেন। অন্যদিকে বিষ্ণু নারায়ণের
স্ত্রী গঙ্গাময়ী তার একমাত্র নাবালক পুত্র উপেন্দ্র নারায়ণের পক্ষে নিজ জমিদারি
পরিচালনা করেন। অতঃপর এ বংশ সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু জানা যায় না। আজ ইটাকুমারী বা
ফতেপুর তিন আনা জমিদারি সম্পর্কে কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে উনবিংশ শতাব্দীর
শেষের দিকে কৃষ্ণচন্দ্র রায় চৌধুরী ইটাকুমারীর জমিদার ছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু
রাজা শিবচন্দ্রের সাথে তার সম্পর্ক জানা যায়নি। ধারণা করা হয় যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধাক্কায় শিবচন্দ্রের বংশের হাত থেকে ইটাকুমারীর
জমিদারি হস্তচ্যুত হয়ে ময়মনসিংহ জেলার শেরপুরের আচার্য পরিবারের কাছে চলে যায়।
কারণ কৃষ্ণচন্দ্র অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে যে সব উত্তরাধিকারীর নাম পাওয়া যায়
তারা হলেন যতীন্দ্ররায় চৌধুরী, যোগেন্দ্র কুমার রায়
চৌধুরী, উপেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী ও নৃপেন্দ কুমার রায়
চৌধুরী। এরা সবাই শেরপুরের আচার্য বংশের মানুষ।
বর্তমান অবস্থা: ইটাকুমারী শিবচন্দ্র রায় মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক
মোঃ রোকনুজ্জামানের সাথে কথা বলে জানা যায়, ইটাকুমারী জমিদার বংশধরের সরাসরি শেষ
উত্তরাধীকারী উপন্দ্রে নাথ ওরফে মটি এবং নগেন্দ্র নাথ ওরফে ঘটি মৃত্যু
বরণ(আনুমানিক ১৯৯১/১৯৯২খ্রিঃ) করলে তাদের সৎকারের দায়িত্ব পালন করা সহ পুরো স্থাবর
ও অস্থাবর সকল সম্পদের উত্তরাধীকার হিসেবে রংপুরস্থ গুপ্তপাড়া নিবাসী অলক সেন ওরফে
ভুলু বাবু তার দখল দারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ইটাকুমারী ইউপির শ্রীকান্ত গ্রামের মোঃ
আব্দুর রাজ্জাক বলেন পরবর্তিতে জমিদার সম্পত্তির বড় ৪টি পুকুর ৪জন ব্যক্তি (১)
খন্দকার মোঃ আঃ রফিক ওরফে রফিক গুন্ডা (২) মোঃ আঃ হক্কে (৩) মোঃ আদম আলী এবং (৪)
মোঃ আব্দুর রজ্জাক স্বয়ং যথাক্রমে পুকুর-১, পুকুর-২, পুকুর-৩ এবং পুকুর-৪ এ মাছ চাষ করার জন্য অলক সেন ওরফে
ভুলু বাবুর নিকট থেকে লিজের মাধ্যমে গ্রহণ করেন এবং অদ্যবধি উক্ত সম্পদের উপর
তাদের দখল প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তিনি আরও বলেন লীজ গ্রহণকারী ৪জনই ধারাবাহিকভাবে অলক
সেনের নিকট থেকে তাদের লীজের মেয়াদ বৃদ্ধি করে নিতেন তার মৃত্যুর পর অলক সেনের
স্ত্রী ভারতী রানী লীজ প্রদানের কাজ করতেন। অবশ্য প্রায় বছর খানেক আগে সর্বশেষ
লীজের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও আর কাউকেই তিনি নতুন করে লীজ প্রদান করেননি। ইটাকুমারী
জমিদার বাড়িতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় জমিদারি চাকলা ঘরের পশ্চিম পাশে ধান চাষ করা
হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনের কাছে জানতে চাইলে তার বলে স্থানীয় ব্যক্তি মোঃ আদম আলী
উক্ত ধান চাষ করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপস্থিত এক জন ব্যক্তি বলেন, উপন্দ্রে নাথ
ওরফে মটি এবং নগেন্দ্র নাথ ওরফে ঘটি বাবুর মৃত্যুর পরে উপজেলা প্রশাসন, পীরগাছা এবং জেলা
প্রশাসকের কার্যালয়ের মাধ্যমে গঠিত একটি কমিটি উক্ত সম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব
গ্রহণের চেষ্টা করেছিল কিন্তু জমিদারের সকল সম্পদ পারিবারিক দেবত্তর হিসেবে অলক
সেন ওরফে ভুলু বাবু প্রাপ্ত হয়েছেন মর্মে একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে বিভাগীয়
কমিশনারের কার্যালয়, রাজশাহীর
একটি আদেশে উক্ত কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। ইটাকুমারী গ্রামের সংকর চন্দ্র জানান, একটি স্থানীয়
সনাতন ধর্মাম্বলী সংগঠন জমিদারের সকল সম্পদ সার্বজনীন দেবত্তর হিসেবে অলক সেন ওরফে
ভুলু বাবুকে বিবাদী করে ১৯৯৪ সালের দিকে রংপুর দেওয়ানী আদালতে একটি মামলা দায়ের
করে যার নম্বর ২৮/১৯৯৪ এবং বর্তমানে মামলা টি চলমান রয়েছে। সার্বজনীন দেবত্ত্বর এর
পক্ষে মামলাটি শ্রী সুখেন্দ্র নাথ রায়, পিতাঃ উমা কান্ড বর্মন, সাং- খামার বড়ভিটা, ইটাকুমারী, পীরগাছা, রংপুর পরিচালনা
করেন।